যোগী-কঙ্গনার মিথ্যে আলিঙ্গন: AI ভিডিও ভাইরাল

প্রতারণার ব্যবচ্ছেদ: AI-পরিবর্তিত ফুটেজ উন্মোচন

উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ এবং বিজেপি সাংসদ কঙ্গনা রানাউতকে আলিঙ্গনরত অবস্থায় দেখানো একটি ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলিতে দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। তবে, একটু ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলেই বোঝা যায় যে এই ভিডিওটি আসল নয়। এটি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করে ম্যানিপুলেট করা হয়েছে, ভিডিওটির ভেতরের সূক্ষ্ম অথচ গুরুত্বপূর্ণ বিবরণগুলি থেকেই এই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায়।

ডিজিটাল ম্যানিপুলেশনের চিহ্ন: ওয়াটারমার্ক এবং AI উৎস

ভিডিওটির কৃত্রিম প্রকৃতির সবচেয়ে তাৎক্ষণিক সূচক হল এর নিচের ডানদিকের কোণায় থাকা ওয়াটারমার্কগুলি। এই ওয়াটারমার্কগুলিতে লেখা রয়েছে, ‘Minimax‘ এবং ‘Hailuo AI,’ যা সাধারণত আসল, সম্পাদিত নয় এমন ফুটেজে পাওয়া যায় না। এর পরিবর্তে, এগুলি নির্দিষ্ট AI সরঞ্জাম দ্বারা তৈরি সামগ্রীর বৈশিষ্ট্য। এটি একটি গুরুতর সন্দেহের জন্ম দেয়, যা ভিডিওটির উৎস সম্পর্কে গভীর অনুসন্ধানের প্রয়োজনীয়তা তৈরি করে।

‘Minimax’ এবং ‘Hailuo AI’ অস্পষ্ট কোনো সংস্থা নয়। তারা আসলে, ভিডিও তৈরিতে পারদর্শী এমন AI প্ল্যাটফর্ম। এই সরঞ্জামগুলি ব্যবহারকারীদের টেক্সট এবং ছবি ব্যবহার করে স্ক্র্যাচ থেকে ভিডিও তৈরি করতে সাহায্য করে। তাদের ওয়াটারমার্কের উপস্থিতি দৃঢ়ভাবে ইঙ্গিত করে যে ভাইরাল হওয়া ভিডিওটি কোনো বাস্তব মুহূর্তের দৃশ্য নয়, বরং এটি একটি বানানো সৃষ্টি।

উৎসের মুখোশ উন্মোচন: ২০২১ সালের একটি বৈঠকের ভিজ্যুয়াল ট্রেসিং

সত্যকে আরও উন্মোচন করার জন্য, ভাইরাল ভিডিও থেকে নেওয়া কীফ্রেমগুলি ব্যবহার করে একটি রিভার্স ইমেজ সার্চ করা হয়েছিল। এই কৌশলটি তদন্তকারীদের ভিজ্যুয়াল উপাদানগুলির উৎস সনাক্ত করতে এবং সেগুলি অনলাইনে অন্য কোথায় প্রদর্শিত হয়েছে তা সনাক্ত করতে সহায়তা করে। এই অনুসন্ধানের ফলাফলগুলি সরাসরি ২০২১ সালের ১ অক্টোবর যোগী আদিত্যনাথের অফিসের অফিশিয়াল X (পূর্বে টুইটার) হ্যান্ডেলের একটি পোস্টের দিকে নির্দেশ করে।

২০২১ সালের এই পোস্টটিতে ভাইরাল হওয়া ভিডিওর একই ভিজ্যুয়াল উপাদানগুলি ছিল। তবে, প্রসঙ্গটি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। পোস্টে অভিনেত্রী কঙ্গনা রানাউতের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের সাথে তার লখনউয়ের সরকারি বাসভবনে সৌজন্য সাক্ষাৎকারের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। সেখানে কোনও আলিঙ্গনের উল্লেখ ছিল না এবং ছবিগুলিতে একটি আনুষ্ঠানিক, পেশাদার কথোপকথন দেখা গেছে।

সাক্ষাতের প্রাসঙ্গিকতা: কঙ্গনা রানাউতের ‘তেজস’ শ্যুট এবং ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডরশিপ

গুগলে কীওয়ার্ড অনুসন্ধানের মাধ্যমে, একই সময়ের একাধিক মিডিয়া রিপোর্ট পাওয়া গেছে। এই রিপোর্টগুলি রানাউত এবং আদিত্যনাথের মধ্যে বৈঠকের অতিরিক্ত প্রসঙ্গ সরবরাহ করে। সেই সময়, রানাউত তার সিনেমা ‘তেজস‘-এর শুটিংয়ের জন্য উত্তরপ্রদেশে ছিলেন।

তার সফরের সময়, তিনি মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের সাথে দেখা করেন এবং এই বৈঠকের ফলে তাকে রাজ্যের ‘ওয়ান ডিস্ট্রিক্ট-ওয়ান প্রোডাক্ট’ প্রোগ্রামের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হিসেবে মনোনীত করা হয়। এই প্রোগ্রামের লক্ষ্য ছিল উত্তরপ্রদেশের প্রতিটি জেলার স্থানীয় পণ্য এবং কারুশিল্পের প্রচার করা। এই ইভেন্টের মিডিয়া কভারেজে ধারাবাহিকভাবে একটি আনুষ্ঠানিক এবং সম্মানজনক কথোপকথন দেখানো হয়েছে, যেখানে ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখানো আলিঙ্গনের কোনও ইঙ্গিত ছিল না।

AI-জেনারেটেড সামগ্রীর ক্ষমতা এবং বিপদ: একটি ক্রমবর্ধমান উদ্বেগ

এই ঘটনাটি ডিজিটাল যুগে একটি ক্রমবর্ধমান উদ্বেগকে তুলে ধরে: AI ব্যবহার করে কতটা সহজে বিশ্বাসযোগ্য অথচ সম্পূর্ণ বানোয়াট সামগ্রী তৈরি করা যায়। আদিত্যনাথ এবং রানাউতের ভিডিওটি একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ যে কীভাবে AI সরঞ্জামগুলি বাস্তবতাকে ম্যানিপুলেট করতে এবং জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করতে ব্যবহার করা যেতে পারে।

‘Minimax’ এবং ‘Hailuo AI’-এর পেছনের প্রযুক্তিটি অত্যাধুনিক। এই প্ল্যাটফর্মগুলি ব্যবহারকারীদের সাধারণ টেক্সট প্রম্পট এবং ছবি ব্যবহার করে ভিডিও ক্লিপ তৈরি করতে দেয়। এর অর্থ হল যে কেউ এই সরঞ্জামগুলি অ্যাক্সেস করে এমন ভিডিও তৈরি করতে পারে যা আসলে কখনও ঘটেনি এমন ঘটনাগুলিকে চিত্রিত করে। এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী, বিশেষ করে রাজনীতি, সংবাদ এবং জনমতের ক্ষেত্রে।

সমালোচনামূলক মূল্যায়নের গুরুত্ব: ডিজিটাল যুগে সত্য থেকে মিথ্যাকে আলাদা করা

এই AI-জেনারেটেড ভিডিওর বিস্তার অনলাইন সামগ্রীর সমালোচনামূলক মূল্যায়নের গুরুত্বকে তুলে ধরে। এমন একটি যুগে যেখানে তথ্য সহজেই পাওয়া যায় এবং দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, সেখানে আমরা যা দেখি এবং শুনি তার সত্যতা সম্পর্কে প্রশ্ন করা এবং একটি বিচক্ষণ দৃষ্টি তৈরি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বেশ কয়েকটি বিষয় ব্যক্তিদের অনলাইন সামগ্রীর বিশ্বাসযোগ্যতা মূল্যায়ন করতে সহায়তা করতে পারে:

  • উৎস যাচাইকরণ: তথ্যের উৎস পরীক্ষা করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এটি কি একটি নির্ভরযোগ্য সংবাদ সংস্থা, একটি যাচাইকৃত অ্যাকাউন্ট, নাকি একটি অজানা সত্তা?
  • ক্রস-রেফারেন্সিং: একাধিক উৎস থেকে তথ্যের তুলনা করা এর নির্ভুলতা নির্ধারণ করতে সাহায্য করতে পারে। অন্যান্য বিশ্বাসযোগ্য উৎস কি একই তথ্য রিপোর্ট করছে?
  • অসঙ্গতি খোঁজা: ভিজ্যুয়াল অসঙ্গতি, ওয়াটারমার্ক বা অস্বাভাবিক অডিও সংকেত ম্যানিপুলেশনের সূচক হতে পারে।
  • রিভার্স ইমেজ সার্চিং: গুগলের রিভার্স ইমেজ সার্চের মতো সরঞ্জামগুলি ছবি এবং ভিডিওগুলির উৎস সনাক্ত করতে সহায়তা করতে পারে।
  • মিডিয়া সাক্ষরতা শিক্ষা: মিডিয়া সাক্ষরতা শিক্ষার প্রচার ব্যক্তিদের তথ্য বিশ্লেষণ এবং মূল্যায়ন করতে সক্ষম করতে পারে।

AI ম্যানিপুলেশনের নৈতিক প্রভাব: দায়িত্বের আহ্বান

ম্যানিপুলেটেড সামগ্রী তৈরি এবং প্রচার করা উল্লেখযোগ্য নৈতিক প্রশ্ন উত্থাপন করে। যদিও AI প্রযুক্তি অসংখ্য সুবিধা প্রদান করে, তবে এর অপব্যবহারের সম্ভাবনাকে উপেক্ষা করা যায় না। বিশ্বাসযোগ্য মনে হওয়া ভিডিও এবং ছবি তৈরি করার ক্ষমতা সত্য, বিশ্বাস এবং জ্ঞাত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে একটি হুমকি তৈরি করে।

AI-এর দায়িত্বশীল ব্যবহার সম্পর্কে আলোচনার ক্রমবর্ধমান প্রয়োজন রয়েছে। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে:

  • নৈতিক নির্দেশিকা তৈরি: AI প্রযুক্তির বিকাশ এবং স্থাপনার জন্য স্পষ্ট নৈতিক নির্দেশিকা প্রতিষ্ঠা করা।
  • স্বচ্ছতা প্রচার: AI-এর ব্যবহারে স্বচ্ছতা উৎসাহিত করা, যেমন কখন সামগ্রী AI-জেনারেট করা হয়েছে তা প্রকাশ করা।
  • ভুল তথ্যের বিরুদ্ধে লড়াই: AI-জেনারেটেড ভুল তথ্যের বিস্তার রোধে কৌশল তৈরি করা।
  • ব্যবহারকারীদের ক্ষমতায়ন: ব্যবহারকারীদের ম্যানিপুলেটেড সামগ্রী সনাক্ত করতে এবং রিপোর্ট করার জন্য সরঞ্জাম এবং জ্ঞান সরবরাহ করা।
  • আইনি কাঠামো: AI-জেনারেটেড সামগ্রীর ক্ষতিকারক ব্যবহার মোকাবেলায় আইনি কাঠামো বিবেচনা করা।

আলিঙ্গনের বাইরে: AI-চালিত প্রতারণার ব্যাপক প্রভাব

যোগী আদিত্যনাথ এবং কঙ্গনা রানাউতের বানোয়াট ভিডিওর ঘটনাটি AI-কে প্রতারণামূলক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করার সম্ভাবনার একটি কঠোর অনুস্মারক হিসাবে কাজ করে। যদিও এই বিশেষ ঘটনাটি তুলনামূলকভাবে ছোট মনে হতে পারে, এটি AI-চালিত ম্যানিপুলেশনের একটি বৃহত্তর প্রবণতার প্রতিনিধিত্ব করে যার সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে।

বাস্তবসম্মত কিন্তু মিথ্যা ভিডিও তৈরি করার ক্ষমতা ব্যবহার করা যেতে পারে:

  • রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা ছড়ানো: বানোয়াট ভিডিওগুলি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের খ্যাতি নষ্ট করতে বা মিথ্যা বিবরণ ছড়াতে ব্যবহার করা যেতে পারে।
  • জনমতকে প্রভাবিত করা: AI-জেনারেটেড সামগ্রী গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জনমতকে প্রভাবিত করতে ব্যবহার করা যেতে পারে।
  • সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি: মিথ্যা ভিডিওগুলি সমাজে ক্রোধ, ভয় এবং বিভাজন উস্কে দিতে ব্যবহার করা যেতে পারে।
  • প্রতিষ্ঠানের প্রতি আস্থা হ্রাস: ম্যানিপুলেটেড সামগ্রীর বিস্তার মিডিয়া, সরকার এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের প্রতি জনসাধারণের আস্থা হ্রাস করতে পারে।
  • আর্থিক জালিয়াতির সুবিধা: AI-জেনারেটেড ভিডিওগুলি ব্যক্তিদের ছদ্মবেশ ধারণ করতে এবং আর্থিক জালিয়াতি করতে ব্যবহার করা যেতে পারে।

একটি বহুমুখী পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তা: AI ম্যানিপুলেশনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা

AI ম্যানিপুলেশনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ব্যক্তি, প্রযুক্তি কোম্পানি, সরকার এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির একটি বহুমুখী পদ্ধতির প্রয়োজন।

ব্যক্তিদের সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনার দক্ষতা বিকাশ করতে হবে এবং তারা অনলাইনে যে সামগ্রী গ্রহণ করে সে সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে।

প্রযুক্তি কোম্পানিগুলির AI-জেনারেটেড ভুল তথ্যের বিস্তার সনাক্তকরণ এবং প্রতিরোধ করার জন্য ব্যবস্থা তৈরি এবং বাস্তবায়নের দায়িত্ব রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে AI সনাক্তকরণ প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করা, সামগ্রী সংযম নীতিগুলি উন্নত করা এবং AI-এর ব্যবহারে স্বচ্ছতা প্রচার করা।

সরকারগুলির AI-জেনারেটেড সামগ্রীর ক্ষতিকারক ব্যবহার মোকাবেলায় উপযুক্ত প্রবিধান বিবেচনা করা উচিত, সেইসাথে বাকস্বাধীনতা এবং উদ্ভাবনকে রক্ষা করা উচিত। এর মধ্যে AI-সম্পর্কিত ক্ষতিগুলি বিশেষভাবে মোকাবেলার জন্য বিদ্যমান আইনগুলি আপডেট করা বা নতুন আইন তৈরি করা অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি মিডিয়া সাক্ষরতা এবং সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনার দক্ষতা প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর মধ্যে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত সকল স্তরের পাঠ্যক্রমে মিডিয়া সাক্ষরতা শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।

পদক্ষেপের আহ্বান: AI-এর যুগে সত্যকে রক্ষা করা

AI-জেনারেটেড সামগ্রীর উত্থান সত্য থেকে মিথ্যাকে আলাদা করার আমাদের ক্ষমতার জন্য একটি উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ উপস্থাপন করে। এটি এমন একটি চ্যালেঞ্জ যার সমাধানের জন্য একটি সম্মিলিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন। সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা, দায়িত্বশীল AI উন্নয়ন এবং জ্ঞাত নীতি প্রণয়নের মাধ্যমে, আমরা সত্যকে রক্ষা করতে এবং AI প্রযুক্তিকে প্রতারণার পরিবর্তে ভালোর জন্য ব্যবহার করা নিশ্চিত করতে কাজ করতে পারি। বানোয়াট ভিডিওর ঘটনাটি একটি সতর্কবার্তা হিসাবে কাজ করে, যা আমাদেরকে পদক্ষেপ নিতে এবং ডিজিটাল যুগে তথ্যের সততা রক্ষা করতে উৎসাহিত করে। জ্ঞাত সিদ্ধান্ত গ্রহণ, জনসাধারণের আস্থা এবং গণতান্ত্রিক আলোচনার ভবিষ্যৎ এই বিকশিত ভূদৃশ্যকে সফলভাবে পরিচালনা করার আমাদের ক্ষমতার উপর নির্ভর করে।